আমার মা উলটো। মুরগি পুষবে অথচ ডিম খাবে না। মাংস খাবে না। এই শখ করে মুরগি পোষা নিয়ে মাঝেমাঝে আমার রাগ হয়। আমাদের বাড়ির চারিদিকে গাছ। সামনে আমবাগান। তার দু'পাশে সারি সারি বাঁশবাগান। আর একটু পেরিয়ে সবুজ মাঠ। আমাদের এলাকাটা মফঃস্বল। বাড়ি থেকে হাঁটা পথেই স্কুল, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, থানা... গ্রামের পাশ দিয়ে গেছে জলঙ্গী। এই নদী আমার নিত্যদিনের মনখারাপের সঙ্গী। বিকালের পড়ন্ত আলো বুকে নিয়ে যখন একটু একটু করে জেগে ওঠে, তার পাশে চুপ করে বসি।
আমাদের বাড়ির চারিপাশে গাছপালা আর ফাঁকা হওয়ায় একটু বেশিই
শেয়াল, কুকুরের উপদ্রব। একটু সুযোগ পেলে সামনে যা পাবে খপাৎ... এ নিয়ে মায়ের আক্ষেপ
থাকলেও অনুশোচনা নেই। মুরগি পুষবেই। তবে আব্বা পছন্দ করে গাছপালা লাগাতে। আমাদের বাগানে
আম, জাম, লেবু, নারকেল, সুপারি, কাঁঠাল কী নেই! সব আব্বা নিজে হাতে লাগিয়েছে। সবজি
লাগানো তার ভীষণ পছন্দের। উঠোন বলতে শান বাঁধানো, সামনে যে জায়গাটুকু আছে। সেখানেই
মাচা তুলে পুঁইশাকে মুড়িয়ে রেখেছে। মাঝেমাঝে চালকুমড়ো বা ঢাকাইকুমড়োর গাছ লাগিয়ে বাগানের
মাচায় তুলে দেয়। বাগান আর উঠোনের মধ্যে দূরত্ব খুব কম বলে এই সুবিধা পায়।
যাইহোক, একবার মা বারোটা ডিম তাওয়াতে দিল। সপ্তাহ খানেক পর দেখা গেল আটটা ফুটফুটে বাচ্চা উঠেছে। মা খুব খুশি। তখনও মা খেয়াল করেনি একটি বাচ্চা স্বাভাবিক নয়। তাওয়া থেকে যেদিন নামাল দেখা গেল— একটি বাচ্চার একটি পা খোঁড়া। মুরগির বাচ্চাগুলো এমনিতেই ভীষণ ছটফটে হয়। কিন্তু এই সাতের সঙ্গে এই এক পেরে উঠছে না নিজেদের পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে।
চোখের
সামনে এক প্রতিবন্ধী শিশু মুরগির বেড়ে ওঠার লড়াই দেখাটা সত্যিই ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক।
আমাদের মানুষের মতো ওদের হাত নেই। প্রতিবন্ধী শিশুকে মা যেমন খেয়াল রাখে, হাত দিয়ে
খাওয়ায়, হাত ধরে ধরে হাঁটায়, ধরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা নিয়ে যায়... এদের যেন কেউ
নেই। সম্পূর্ণ একার লড়াই। এই লড়াইয়ের হারজিত আমাদের চোখে পড়ে না।
মা মুরগি পুষলেও, তাদের খেয়াল রাখে আব্বা। আব্বার সবকিছুতেই
একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়। কিন্তু এই বাড়াবাড়িটা বড়োই হৃদয়গামী। একজন মা যতবার তার শিশুকে
ডেকে ডেকে খাওয়ায় আমার আব্বাও মুরগিগুলোকে সেভাবে খাওয়ায়। আশ্চর্য ব্যাপার হল, আব্বা
বাজার করে বাড়ি ফিরলে মুরগিগুলো দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবে। এর আগে একবার ছাগল পুষেছিল।
নাম দিয়েছিলাম মন্টু। মন্টু, আব্বার এতটা কাছের হয়ে গেছিল যে টি.ভির ঘরে এসে পর্যন্ত
বসত।
সেদিন মুরগিগুলো গেট পার হয়ে বাগানের দিকে চলে গেছে। শুধু
ওই প্রতিবন্ধী মুরগিটি ছাড়া। 'পিক, পিক' করে ডাকছে। মা বলল, 'দ্যাখ, তো মুরগিটা বোধহয়
পেরোতে পারছে না'। আমি পেরোতে গেছি, ওমনি মা মুরগি চঞ্চু বাড়িয়ে তেড়ে আসছে। আর একটু
হলেই ঠোকরাতো।
পাখিদের জগৎটা মানুষদের থেকে আলাদা নয়। একজন অসহায় মা মুরগির চোখ রাঙানি যেন বলছিল, এই মনুষ্যসমাজকে বিশ্বাস করি না। আজ বারবার মনে হচ্ছে, পাখিদের জন্য কোনো হুইলচেয়ার হয় না? ক্র্যাচার হয় না? নাকি এই আমরা নিজেদের দখলে পৃথিবীকে প্রতিবন্ধীদের সংগ্রহশালা গড়ে তুলছি? যেখানে শুধু মানুষ আর মানুষ। ডিম নেই। অথচ, ফুটে ওঠার কত কলাকৌশল!
No comments:
Post a Comment