Friday 17 March 2023

মুরগি কথা

আমার মা উলটো। মুরগি পুষবে অথচ ডিম খাবে না। মাংস খাবে না। এই শখ করে মুরগি পোষা নিয়ে মাঝেমাঝে আমার রাগ হয়। আমাদের বাড়ির চারিদিকে গাছ। সামনে আমবাগান। তার দু'পাশে সারি সারি বাঁশবাগান। আর একটু পেরিয়ে সবুজ মাঠ। আমাদের এলাকাটা মফঃস্বল। বাড়ি থেকে হাঁটা পথেই স্কুল, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, থানা... গ্রামের পাশ দিয়ে গেছে জলঙ্গী। এই নদী আমার নিত্যদিনের মনখারাপের সঙ্গী। বিকালের পড়ন্ত আলো বুকে নিয়ে যখন একটু একটু করে জেগে ওঠে, তার পাশে চুপ করে বসি। 

আমাদের বাড়ির চারিপাশে গাছপালা আর ফাঁকা হওয়ায় একটু বেশিই শেয়াল, কুকুরের উপদ্রব। একটু সুযোগ পেলে সামনে যা পাবে খপাৎ... এ নিয়ে মায়ের আক্ষেপ থাকলেও অনুশোচনা নেই। মুরগি পুষবেই। তবে আব্বা পছন্দ করে গাছপালা লাগাতে। আমাদের বাগানে আম, জাম, লেবু, নারকেল, সুপারি, কাঁঠাল কী নেই! সব আব্বা নিজে হাতে লাগিয়েছে। সবজি লাগানো তার ভীষণ পছন্দের। উঠোন বলতে শান বাঁধানো, সামনে যে জায়গাটুকু আছে। সেখানেই মাচা তুলে পুঁইশাকে মুড়িয়ে রেখেছে। মাঝেমাঝে চালকুমড়ো বা ঢাকাইকুমড়োর গাছ লাগিয়ে বাগানের মাচায় তুলে দেয়। বাগান আর উঠোনের মধ্যে দূরত্ব খুব কম বলে এই সুবিধা পায়।

যাইহোক, একবার মা বারোটা ডিম তাওয়াতে দিল। সপ্তাহ খানেক পর দেখা গেল আটটা ফুটফুটে বাচ্চা উঠেছে। মা খুব খুশি। তখনও মা খেয়াল করেনি একটি বাচ্চা স্বাভাবিক নয়। তাওয়া থেকে যেদিন নামাল দেখা গেল— একটি বাচ্চার একটি পা খোঁড়া। মুরগির বাচ্চাগুলো এমনিতেই ভীষণ ছটফটে হয়। কিন্তু এই সাতের সঙ্গে এই এক পেরে উঠছে না নিজেদের পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে।

চোখের সামনে এক প্রতিবন্ধী শিশু মুরগির বেড়ে ওঠার লড়াই দেখাটা সত্যিই ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক। আমাদের মানুষের মতো ওদের হাত নেই। প্রতিবন্ধী শিশুকে মা যেমন খেয়াল রাখে, হাত দিয়ে খাওয়ায়, হাত ধরে ধরে হাঁটায়, ধরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা নিয়ে যায়... এদের যেন কেউ নেই। সম্পূর্ণ একার লড়াই। এই লড়াইয়ের হারজিত আমাদের চোখে পড়ে না।  

মা মুরগি পুষলেও, তাদের খেয়াল রাখে আব্বা। আব্বার সবকিছুতেই একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়। কিন্তু এই বাড়াবাড়িটা বড়োই হৃদয়গামী। একজন মা যতবার তার শিশুকে ডেকে ডেকে খাওয়ায় আমার আব্বাও মুরগিগুলোকে সেভাবে খাওয়ায়। আশ্চর্য ব্যাপার হল, আব্বা বাজার করে বাড়ি ফিরলে মুরগিগুলো দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবে। এর আগে একবার ছাগল পুষেছিল। নাম দিয়েছিলাম মন্টু। মন্টু, আব্বার এতটা কাছের হয়ে গেছিল যে টি.ভির ঘরে এসে পর্যন্ত বসত।

সেদিন মুরগিগুলো গেট পার হয়ে বাগানের দিকে চলে গেছে। শুধু ওই প্রতিবন্ধী মুরগিটি ছাড়া। 'পিক, পিক' করে ডাকছে। মা বলল, 'দ্যাখ, তো মুরগিটা বোধহয় পেরোতে পারছে না'। আমি পেরোতে গেছি, ওমনি মা মুরগি চঞ্চু বাড়িয়ে তেড়ে আসছে। আর একটু হলেই ঠোকরাতো।

পাখিদের জগৎটা মানুষদের থেকে আলাদা নয়। একজন অসহায় মা মুরগির চোখ রাঙানি যেন বলছিল, এই মনুষ্যসমাজকে বিশ্বাস করি না। আজ বারবার মনে হচ্ছে, পাখিদের জন্য কোনো হুইলচেয়ার হয় না? ক্র্যাচার হয় না? নাকি এই আমরা নিজেদের দখলে পৃথিবীকে প্রতিবন্ধীদের সংগ্রহশালা গড়ে তুলছি? যেখানে শুধু মানুষ আর মানুষ। ডিম নেই। অথচ, ফুটে ওঠার কত কলাকৌশল!

Monday 15 June 2020

মন জানে না মনের খবর, পড়শি জানবে ক্যামনে?

ছেলেটি হাসিখুশি, সে কি আত্মহত্যা করতে পারে?

মেয়েটি জনপ্রিয়, সে কি আত্মহত্যা করতে পারে?

লোকটি ধনী, সে কি আত্মহত্যা করতে পারে?

মহিলাটির সুন্দর সাজানো সংসার, সে কি আত্মহত্যা করতে পারে?

কোনো আত্মহত্যার খবর যখনই আসে এই প্রশ্নগুলো ঘোরেফেরে। সত্যিই কি এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর হয়? এই উত্তর কি কখনো হতে পেরেছে সমাধানমালা?          

    বাউলেরা বারবার বলে গেছেন, মনকে নিবিষ্ট রাখতে। মনকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে বিশ্বকে জয় করা। মনকে আমরা কখনো জয় করতে পারিনি বা করার চেষ্টাই করিনি। নানা কারণে আমাদের মানসিক অবসাদ আসতে পারে‍‍‍‍  কলহ, বিবাদ, সম্পর্ক, কেরিয়ার, যৌনতা কোথাও কোনো গণ্ডগোল দেখা দিলে। এই অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে কেউ অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন, কেউ কেউ আত্মহত্যা করে বসেন। এর মাঝামাঝি কিছু মানুষ আছে যাঁরা অপরাধমূলক কাজে জড়াতে বা আত্মহত্যা করতে ভয় পান। 

    কিছুদিন আগে একজনের ফেসবুক টাইমলাইন দেখে সন্দেহ হয়। না, টাইমলাইনে সে আত্মহত্যা সম্পর্কিত কোনো পোস্ট করেনি। মৃত্যু সম্পর্কিত কোনো ইঙ্গিতও দেয়নি। কেন জানি না, বারবার মনে হচ্ছিল কোনো সমস্যার মধ্যে আছে। আমি ওই ব্যক্তির কাছের একজনের থেকে খবর নিয়ে জানতে পারি সে মানসিক অবসাদে ভুগছে। কাউন্সিলিং করিয়েও বেরোতে পারছে না। প্রণয়ঘটিত কারণ। সে বেরোতে চাইছে। আর বেরোতে চাইছে বলেই ফেসবুকে সারদিনে পোস্ট করছে নিজের ছবি, নানারকম স্ট্যাটাস। নিজের টাইমলাইনে কমেন্টের রিপ্লাইতে খিল্লি করছে। চাইছে মন ডাইভার্ট করতে। কে বুঝবে ওর সমস্যার কথা? ব্যক্তিটি যদি নিজের এডিট করা হাসিখুশি মুখের ছবি পোস্ট করার দশমিনিটের মধ্যে আত্মহত্যা করে তাহলে কি তাকে বলব সে ঠিক ছিল?

    কিছুদিন আগেই এক স্কুল ফ্রেণ্ডের আত্মহত্যার একটা ভিডিও ফুটেজ হোয়াটস্‌অ্যাপে আসে। বন্ধুটার স্ত্রী ও মেয়ে থাকা সত্ত্বেও পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। ভিডিও দেখে সেই রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। ফেসবুক লাইভে এসে ঝুলে পড়ে। দড়ি বাঁধা থেকে শুরু করে কীভাবে আত্মহত্যা করল সবটাই ফুটেছে ধরা পড়েছে। আর ফোনে বারবার তার প্রেমিকাকে কথা বলার অনুরোধ করছে, কিন্তু মেয়েটি কথা বলতে চায় না। ফোনেই হুমকি দেয়, কথা না বললে আত্মহত্যা করবে। মান-অভিমানে এমন মৃত্যুর কথা আমারা অনেকেই বলে ফেলি। ওর সেই প্রেমিকা কি ভেবেছিল, সত্যিই ফোন লাইনে রেখে, ফেসবুক লাইভে এভাবে তার প্রেমিক আত্মহত্যা করবে? বুঝতে পারলে কি সে কথা বলত না?

    আমাদের মনই জানে না মনের খবর, পড়শি জানবে ক্যামনে? মানুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে যায়। কিন্তু সে যদি নিজের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারে কখনো ক্লান্ত হবে না। মন তখনই নিয়ন্ত্রণে আসবে যখন বশে থাকবেপুরাণ থেকে কোরাণ সর্বত্রই আত্মহত্যাকে ঘৃণাযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে। দিনের পর দিন এই ঘৃণাযোগ্য অপরাধ বেড়েই চলছে। এর দায় কার? অপরাধী কে? কোনো উত্তর হয় না। খুব সকালে উঠে কোনোদিন যদি দেখি‍‍‍‍  আমাদের মৃত লাশের ওপর সকালের মিঠে রোদ একা একা কান্না করছে আর আমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার মানুষগুলো ফিরে গেছে খুব ভোরে, সেদিন আমাদের কি খুব বিষণ্ণ লাগবে?

    আমাদের নিজের সঙ্গে কথা বলার সময় কি আছে? দ্রুতগামী বিশ্বের মানুষ আরও দ্রুতগামী। সবাই ছুটছে। সবাই ব্যস্ত। কান বন্দক। কানে হেডফোন। কাকে বলবে এই অবসাদের কথা? কেউ শুনবে না। শুনলেও ভুলে যাবে। চুপচাপ বসে থেকে মনকে জিজ্ঞাসা করো। কী পারবি তুই? তুই কি সিনেমা দেখবি? তুই কি গান শুনবি? তুই কি আমার সঙ্গে কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো মার্কেটে ঘুরবি? তুই কি অফিসের কাজে আমাকে হেল্প করবি? তুই কি রেলস্টেশনের ভিড়ের মধ্যে ফাঁকা জায়গাটা খুঁজে দিবি? বিকালে গঙ্গার ধারে আমার সঙ্গে সূর্যাস্ত দেখবি? সারাদুপুর বৃষ্টিতে ভিজবি? ভোরে উঠে পাখিদের ডাক শুনবি? আরও হাজার প্রশ্ন করো। মনই উত্তর দেবে। মনই নিজের মুক্তির উপায় বলবে।

    মন বড়ো নিঃসঙ্গ। সে সঙ্গী চায়। তুমি নিজেই একমাত্র তার সঙ্গী। তাকে আশ্রয় দাও। সে গৃহহীন হলে আরও দাপাদাপি করবে।